আশরাফ সিদ্দিকী
আশরাফ সিদ্দিকী (১ মার্চ ১৯২৭ - ১৯ মার্চ ২০২০) ছিলেন একজন বাঙালি সাহিত্যিক, লোকগবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক।[১] বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন যেসব সাহিত্যিক, আশরাফ সিদ্দিকী তাদের একজন। তিনি পাঁচশ'র ও অধিক কবিতা রচনা করেছেন। গভীর গবেষণা করেছেন বাংলার লোকঐতিহ্য নিয়ে। তিনি একাধারে প্রবন্ধকার, ছোটগল্প লেখক, ঔপন্যাসিক, লোকসাহিত্যিক, এবং শিশু সাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন।[২]
আশরাফ সিদ্দিকী | |
---|---|
জন্ম | টাঙ্গাইল, পূর্ব বাংলা, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) | ১ মার্চ ১৯২৭
মৃত্যু | ১৯ মার্চ ২০২০ | (বয়স ৯৩)
পেশা | লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক |
ভাষা | বাংলা |
জাতীয়তা | বাংলাদেশি |
শিক্ষা | বাংলা সাহিত্য, লোকসাহিত্য |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান | ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় |
ধরন | কাব্য, গল্প, লোকসাহিত্য, উপন্যাস |
বিষয় | লোকসাহিত্য, শিশুতোষ |
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি |
|
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার |
সক্রিয় বছর | ১৯৫০ - ২০২০ |
দাম্পত্যসঙ্গী | সাঈদা সিদ্দিকী (বি. ১৯৫১–১৯৯৭) |
সন্তান | ৫ |
ওয়েবসাইট | |
www |
প্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাজন্ম
সম্পাদনাআশরাফ সিদ্দিকী ১৯২৭ সালের ১ মার্চ তার নানাবাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার নাগবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আব্দুস সাত্তার সিদ্দিকী ছিলেন একজন শৌখিন হোমিও চিকিৎসক এবং ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান। আর মা সমীরণ নেসা ছিলেন স্বভাব কবি।[৩]
শিক্ষা জীবন
সম্পাদনাআশরাফ সিদ্দিকী তার নানাবাড়ির পাঠশালায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন তার বাবার প্রতিষ্ঠিত রতনগঞ্জ মাইনর স্কুলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন প্রথম কবিতা লিখেন, কবিতার নাম নববর্ষা।[৩] সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে। মামা আবদুল হামিদ চৌধুরীর বাসায় থেকে পড়াশুনা করতেন আর পাশাপাশি কবিতা লিখতেন। সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীন তার কবিতা স্বগত ও পূর্বাশা সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ সময় তিনি কিছু আঞ্চলিক বাংলা ধাঁধা সংগ্রহ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ তার প্রশংসা করেন। এর কিছু দিন পর তিনি শান্তিনিকেতনে পড়ার জন্য ভারতে চলে যান। ১৯৪৭ সালে শান্তিনিকেতনে বাংলায় অনার্স পড়াকালীন দেশবিভাগ হলে তিনি দেশে ফিরে আসেন।[৪] তিনি ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ টাঙ্গাইলের করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। অনার্স কোর্সে বাংলা সাহিত্যে তিনি সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হন। তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার এমএ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে লোকসাহিত্যে পিএইচডি করেন।[২]
কর্মজীবন
সম্পাদনাসিদ্দিকী ১৯৫০ সালে টাঙ্গাইলের কুমুদীনি কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫১ সালে এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ায় তার সাথে গবেষণার জন্য ঐ বছর নভেম্বর মাসে ডেপুটেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে আবার ফিরে যান রাজশাহী কলেজে। তিনি ১৯৫৭ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে বদলি হয়ে ঢাকা কলেজে যোগ দেন এবং সেখান থেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান।[৫]
১৯৬৭ সালে পিএইচডি শেষ করে কিছুদিন ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যাপনা করেন। একই বছর ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার এ প্রধান সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।[৫] ১৯৬৮ সালে দায়িত্ব পান তদানীন্তন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকের। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ছয় বছর বাংলা একাডেমীর দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৮৩ সালে জগন্নাথ কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেন।[৬]
পারিবারিক জীবন
সম্পাদনাতিনি ১৯৫১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সাঈদা সিদ্দিকীকে বিবাহ করেন। স্ত্রী সাঈদা সিদ্দিকী ছিলেন আজিমপুর গালর্স হাই স্কুলের শিক্ষিকা। তাদের পাঁচ সন্তান সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এবং নিজ নিজ পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। তার পুত্র সাঈদ সিদ্দিকী ক্যাটস্ আই-এর চেয়ারম্যান, নাহিদ আলম সিদ্দিকী'স ইন্টারন্যাশনাল-এর অধ্যক্ষ, কন্যা তাসনিম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পুত্র রিফাত আহম্মেদ সিদ্দিকী'স ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারপারসন, ও রিয়াদ সিদ্দিকী ক্যাটস্ আই-এর পরিচালক।
মৃত্যু
সম্পাদনাতিনি ২০২০ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।[৭] বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
সাহিত্য জীবন
সম্পাদনাদেশবিভাগের পর অভাবের তাড়নায় এক স্কুল শিক্ষক তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনা তাকে নাড়া দেয় এবং তার সাহিত্য রচনার প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি লেখেন তালেব মাষ্টার নামে একটি কবিতা, যা ১৯৫০ সালে তালেব মাষ্টার ও অন্যান্য কবিতা কাব্যসংকলনে স্থান পায়। এরপর প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ সাত ভাই চম্পা, বিষকন্যা, ও উত্তরের তারা। ১৯৬৫ সালে রাবেয়া আপা নামক গল্প দিয়ে গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু গলির ধারের ছেলেটি তাকে গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।[৬] এ গল্প অবলম্বনে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত পরিচালিত ডুমুরের ফুল চলচ্চিত্রটি একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।[৪]
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক সাহিত্য বিষয়ে পড়াকালীন তিনি রচনা করেন শিশুতোষ সাহিত্য সিংহের মামা ভোম্বল দাস যা ১১ টি ভাষায় অনূদিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশের লোক সাহিত্য নিয়ে লিখেন লোক সাহিত্য প্রথম খন্ড। এরই ধারাবিহিকতায় কিংবদন্তির বাংলা, শুভ নববর্ষ, লোকায়ত বাংলা, আবহমান বাংলা, বাংলার মুখ বইগুলো প্রকাশিত হয়। ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে শুনা রূপকথার গল্প থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯১ সালে লেখেন বাংলাদেশের রূপকথা নামক বইটি।[৩]
সাহিত্যকর্ম
সম্পাদনাকাব্যগ্রন্থ
- তালেব মাষ্টার ও অন্যান্য কবিতা (১৯৫০)
- সাত ভাই চম্পা (১৯৫৩)
- বিষকন্যা (১৯৫৫)
- উত্তরের তারা
- বৃক্ষ দাও, ছায়া দাও (১৯৮৪)
- দাঁড়াও পথিক বর (১৯৯০)
- সহস্র মুখের ভিড়ে (১৯৯৭)
গল্পগ্রন্থ
- রাবেয়া আপা (১৯৬৫)
- গলির ধারের ছেলেটি (১৯৮১)
- শেষ নালিশ (১৯৯২)
লোকসাহিত্য
- লোক সাহিত্য প্রথম খণ্ড (১৯৬৩)
- রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন (১৯৭৪)
- কিংবদন্তির বাংলা (১৯৭৫)
- শুভ নববর্ষ (১৯৭৭)
- লোকায়ত বাংলা (১৯৭৮)
- আবহমান বাংলা (১৯৮৭)
- বাংলার মুখ (১৯৯৯)
- প্যারিস সুন্দরী (১৯৭৫)
- বাংলাদেশের রূপকথা (১৯৯১)
- লোক সাহিত্য দ্বিতীয় খণ্ড
শিশুসাহিত্য
- রুপকথার রাজ্যে
- বাণিজ্যেতে যাবো আমি
- অসি বাজে ঝনঝন
- ছড়ার মেলা
- আমার দেশের রুপকাহিনী
- সিংহের মামা ভোম্বল দাস
উপন্যাস
- শেষ কথা কে বলবে (১৯৮০)
- আরশী নগর (১৯৮৮)
- গুনীন (১৯৮৯)
পুরস্কার ও সম্মাননা
সম্পাদনাআশরাফ সিদ্দিকী বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদকসহ ৩৬টি পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার জীবন ও কীর্তি নিয়ে জীবন-সংস্কৃতির জলছবি নামক একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেছে আশরাফ সিদ্দিকী ফাউন্ডেশন, যেখানে তার শৈশব ও সাক্ষাৎকারসমূহ চিত্রায়িত হয়েছে। এছাড়াও তার তালেব মাস্টার ও অন্যান্য কবিতা সংকলনের একটি সিডি বের করেছে আশরাফ সিদ্দিকী ফাউন্ডেশন।[৮]
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৪)
- রিডার্স ডাইজেস্ট পুরস্কার (১৯৬৪)
- ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬)
- একুশে পদক (১৯৮৮)
- ড. দীনেশচন্দ্র সেন সম্মাননা
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "লোকগবেষক আশরাফ সিদ্দিকী আর নেই"। প্রথম আলো। ২০ মার্চ ২০২০। পৃষ্ঠা ৪।
- ↑ ক খ "ড. আশরাফ সিদ্দিকীর ৮৭তম জন্মদিন আজ"। ঢাকা, বাংলাদেশ: দৈনিক যুগান্তর। ১ মার্চ ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০১৬।
- ↑ ক খ গ "যে আছে মাটির কাছাকছি"। ঢাকা, বাংলাদেশ: দৈনিক সমকাল। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪। ১৪ জুন ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০১৬।
- ↑ ক খ তাসনিম সিদ্দিকী (৪ মার্চ ২০১৫)। "Dr. Ashraf Siddiqui: Poet or Folklorist?"। ঢাকা, বাংলাদেশ: দ্য ডেইলি অবসারভার। ১৬ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০১৬।
- ↑ ক খ "শুভ জন্মদিনঃড.আশরাফ সিদ্দিকী"। ঢাকা, বাংলাদেশ: এগ্রিলাইফ২৪.কম। ১ মার্চ ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২০ জানুয়ারি ২০১৬।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ "বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন আশরাফ সিদ্দিকী"। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। ৫ মে ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০১৬।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "চলে গেলেন লোকসাহিত্যিক ড. আশরাফ সিদ্দিকী, প্রথম আলো ১৯ মার্চ ২০২০"। ২৮ মার্চ ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০২০।
- ↑ "Documentary and website on Dr. Ashraf Siddiqui"। ঢাকা, বাংলাদেশ: দ্য ডেইলি স্টার। ৭ মে ২০১২। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০১৬।